বাংলাদেশে সরকারের বিরোধীরা দাবি করছে- দেশে গণতন্ত্র ভেঙে পড়েছে। তারা ২০১৪ সালের নির্বাচনকে অবৈধ বলেছিল এবং এখন আসন্ন নির্বাচন নিয়েও সেই একই রকম মন্তব্য করতে চলেছে। তারা অভিযোগ করছে বিরোধী পক্ষের কয়েকজন নেতার নিরুদ্দেশ হওয়ার পিছনে সরকারে ষড়যন্ত্র রয়েছে।
তাদের এই ধরনের বক্তব্য সঠিক নয়। এরমধ্যে তাদের একটি দাবিও সত্যি নয়।
সত্যিটা হল, বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টি (বিএনপি) প্রথমে ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করেছিল। পরে অভিযোগ করেছিল, গুটিকয়েক রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল এবং এটি একটি কলঙ্কময় অধ্যায়। আসলে এটি ছিল উদ্দেশ্যপ্রনোদিত একটি অপপ্রচার।
২০১৪ সালের নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ- এই অভিযোগ এনে বিএনপি’ই গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে দূরে থেকেছে, শাসক দল আওয়ামী লীগ নয়। ওই নির্বাচনকে বিতর্কিত প্রমাণ করার জন্য বিএনপি তাদের একজন প্রার্থীকেও নির্বাচনী লড়াইয়ে রাখেনি।
২০১৪ সালে বিএনপি বাংলাদেশে ব্যর্থ হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারংবার বলেছেন, অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন গণতন্ত্রের ভিত্তিপ্রস্তর এবং এমনকি নির্বাচনের উপর নজরদারি চালানোর জন্য বিএনপির সাহায্যও চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিএনপি সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করে এবং কার্যত হিংসার পথ অবলম্বন করে। তাদের একাধিক নেতা নির্বাচনকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগের সিদ্ধান্ত নেয়।
সেই বিএনপি’ই এইবছর নির্বাচনে আবার ফিরে আসতে চাইছে। ফের তারা গোটা দেশে অস্থিরতা এবং হিংসার বাতাবরণ তৈরির হুমকি দিচ্ছে।
২০১৪ সালে বিএনপি নেতৃত্ব তাদের সহযোগী জামাত-ই-ইসলামী’র সঙ্গে মিলিত হয়ে হিংসাত্বক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে এবং নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করেছে, আমাদের দেশের মানুষকে চোখের জল ফেলতে বাধ্য করেছে। তারা এবং তাদের সহযোগীরা সহস্রাধিক বাড়ি, গাড়ি, দোকানে অগ্নিসংযোগ করেছে। তারা বিদ্যৎকেন্দ্র ধ্বংস করেছে, ২০জন সরকারি আধিকারিককে খুন করেছে, সরকারি ভবনগুলিতে আগুন লাগিয়েছে। নির্বাচনের দিন পেট্রোল বোমা ব্যবহার করে তাদের রাজনৈতিক বিরোধীদের সন্ত্রস্ত করে রেখেছিল।

২০১৪ সালে বাংলাদেশে নির্বাচনের দিন একটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে জ্বলছে ব্যালট বাক্স। – ফাইল চিত্র।
‘হিউম্যান রাইট ওয়াচ’কে দেওয়া সাক্ষাৎকার এক ব্যক্তি বলেন, ‘‘যারা আক্রমণ চালিয়েছিল তারা আমাদের প্রতিবেশী, গ্রামেরই অপর প্রান্তে থাকে। তারা প্রত্যেকেই বিএনপি এবং জামাতে’র সমর্থক। তারা আমাদের ভোট দিতে যেতে বারণ করে। সকাল ৯-১১টা পর্যন্ত তারা কার্যত রাস্তা বন্ধ করে রাখে, যাতে কেউ ভোটগ্রহণকেন্দ্রে পৌঁছতে না পারে। এরপর ১১টা থেকে তারা ফের আক্রমণ শুরু করে।’’
একাধিক বিএনপি নেতা এই হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ফলশ্রুতি হিসাবে এই রাজনৈতিক দলটির জনপ্রিয়তা তালানিতে ঠেকেছে।
কিন্তু বিএনপি কখনও এসব অগণতান্ত্রিক কাজকর্মের দায় স্বীকার করেনি। যখন বিএনপি সমর্থিত আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়, তখন বিএনপি অভিযোগ করে ‘‘সরকারি মদতে তাদের নেতা-কর্মীদের গুম করে দেওয়া হচ্ছে এবং জেলে পাঠানো হচ্ছে।’’ এই রকম অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তারা কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেনি। তারা যেটা করেছে তা হল, হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার ভয়ে আত্মগোপন করেছে।
যেমন সালাউদ্দিন আহমেদ, খবর হয়েছিল ২০১৫ সালে বাংলাদেশ পুলিশ তাঁকে অপহরণ করেছিল। দু’মাস পর ভারতে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়, এবং পুলিশ দ্রুত বিষয়টি সমাধান করে এবং পরিষ্কার হয়ে যায় বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার হাত থেকে বাঁচতে তিনি এই গোটা নাটকটি রচনা করেছিলেন। ‘নিরুদ্দেশ’ হওয়া অন্যরাও দ্রুত ফিরে এসেছেন। যেমন বিএনপি ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহারের নিখোঁজ হওয়ার খবর সামনে আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর খোঁজ মেলে, যখন তিনি দক্ষিণপশ্চিম খুলনার দিক থেকে রাজধানী ঢাকাগামী একটি বাসে সফর করছিলেন।
আরও পড়ুন: সমীক্ষা বলছে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বেড়েছে
সরকার আশা করবে বিএনপি নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে এবং ২০১৮’র নির্বাচনে হিংসাত্মক রাজনীতি বন্ধ করে মতাদর্শের ভিত্তিতে লড়াই করবে। বাংলাদেশ তাদের বিরোধীদলের কাছ থেকে কেবল এটুকুই প্রত্যাশা করে।
বিএনপি’র অনেকেই আক্ষেপের সুরে বলছেন, তাঁরা সেভাবে কিছু করতে পারছেন না। কারণ, তাঁদের প্রাক্তন নেত্রী খালেদা জিয়া জেলে রয়েছেন। অনেকে তাঁর মুক্তির দাবি জানাচ্ছেন। এমন কি হুমকিও দিচ্ছেন, খালেদা জিয়া ছাড়া না পেলে তারা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটিয়ে পথে নামবেন।
আরও পড়ুন: এস কে সিনহা’র বই কাদের আর্থিক সহায়তায়,কাদের স্বার্থে, গোপন তথ্য ফাঁস
যদি তা ঘটে তাহলে বাংলাদেশ সরকার আইনের শাসন বজায় রাখতে শক্ত হাতে তার মোকাবিলা করবে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে ২৫০,০০০ ডলার আত্মসাতের অভিযোগে গত ফেব্রুয়ারী মাসে খালেদা জিয়ার পাঁচ বছর কারাদন্ড হয়। তাঁর বিরুদ্ধে এখনও ১৯টি মামলা বাকি রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি মামলা তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্ব’র সময়ে দুর্নীতির উপর, মামলাগুলি করেছিল স্বাধীন সংস্থা অ্যান্টি করাপশন কমিশন এবং ১৪টি মামলা ২০১৪ সালে’র দাঙ্গা সংক্রান্ত।
খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান এখন বিএনপি’র সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তিনিও অভিযুক্ত। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ হাইকোর্ট অর্থ পাচারের দায়ে তাঁকে অভিযুক্ত করে। এই মামলায় প্রথমবার মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই বাংলাদেশের আদালতে প্রমাণ পেশ করে। তারেক রহমান ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগেও অভিযুক্ত। যেই গ্রেনেড হামলায় ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল এবং শেখ হাসিনা-সহ ৩০০ জন জখম হয়েছিলেন। বিএনপি’র অনেক নেতার মতোই তারেক রহমান আইনের হাত থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
তাঁদের এই অনুপস্থিতি বাস্তব। কিন্তু কোনও একজনের অনুপস্থিতিকে পুরো বিএনপি দল ভোটারদের কাছে অজুহাত হিসাবে খাড়া করতে পারে! ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করেছিল এবং বর্তমানে তারা যে ধরনের পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে তার সমালোচনা করতেই হয়। তারা এই ধরনের বিদ্রোহ করে হয়ত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে ভুল বোঝাতে পারবে না। কারণ, বাংলাদেশের মানুষ তাদের ভালোভাবে চেনে এবং জানে। দেশের মানুষ ভালো কিছু আশা করে।