ড: শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে নিয়ে মানুষের মনে আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। কেবলমাত্র ২৩শে জুলাই তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীর দিন তাঁর মৃত্যু রহস্য নিয়ে বা ৬ই জুলাই তাঁর জন্মতিথিতে আলোচনার মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকছে না। সারা বছর ধরেই এখন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর জীবন, কর্মকান্ড নিয়ে চর্চা চলছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের উৎসাহ লক্ষণীয়।
শ্যামাপ্রসাদের কর্মমুখর সংক্ষিপ্ত জীবনে অনেকগুলো দিক ছিল। সব ধরনের মানবিক এবং সামাজিক কাজে তিনি নিজের দক্ষতা, দূরদর্শিতার প্রমাণ রেখে গেছেন। গত ২৩শে জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুবার্ষিকীতে মধ্যপ্রদেশে এক অনুষ্ঠানে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে সমৃদ্ধ বক্তব্য রাখেন। প্রধানমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদের জীবনের তিনটি দিকের কথা উল্লেখ করেন- ‘বিদ্যা (শিক্ষা), বিত্ত (অর্থনীতি), বিকাশ’।
শ্যামাপ্রসাদের জীবন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এই তিনটি বিষয়ই ঘুরে ফিরে আসবে। তিনি নিজের কর্মজীবনের শুরুতে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে তিনিই সর্বকনিষ্ঠ উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যর দায়িত্ব নিয়েই শ্যামাপ্রসাদ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারমূলক কাজ করেন। তিনি ভারতীয় ভাষা, বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ, কৃষিবিদ্যা, ভারতীয় ইতিহাস ও সভ্যতা নিয়ে পাঠক্রমের প্রতি বিশেষভাবে নজর দেন। পাশাপাশি চিনা এবং বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ-এর বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার জন্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেদিন বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। যা বৃটিশ শাসনকালে ভারতের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম।
আরও পড়ুন: পশ্চিমবঙ্গ ও শ্যামাপ্রসাদ
এমনকী পরবর্তী সময়ে তিনি দেশের প্রথম সারির শিক্ষা এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। সেই তালিকায় ব্যাঙ্গালুরু’র ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউশন অব সায়েন্স-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলি রয়েছে। ১৯৩০-১৯৫২ সালের মধ্যে তিনি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যে ভাষণ রেখেছিলেন তাতে ছিল গভীর ভাবনা এবং জ্ঞানের ছাপ। শ্যামাপ্রসাদ উচ্চশিক্ষায় নতুনত্ব আনা এবং সায়ত্বশাসনের বিষয়ে চাপ দেন। তিনি মূল গবেষণার উপর জোর দেন এবং তিনি যুক্তি দেন প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে তার নিজস্বতা তৈরির দিকে নজর দিতে হবে।
তিনি দেশের প্রাথমিক ও উচ্চ শিক্ষাকে আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়েছিলেন, শিক্ষার সঙ্গে শিল্পের সংযোগ স্থাপনের প্রয়োজনিয়তার কথাও তিনি বলেছিলেন। তাঁর এই চিন্তাভাবনা আজও কতটা প্রাসঙ্গিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শিক্ষাবিদ হিসাবে তাঁর সুনামের জন্য এবং একজন অদম্য জাতীয়তাবাদী নেতা হিসাবে তাঁকে শ্রী অরবিন্দ আশ্রমের শ্রীমা পুদুচেরিতে (১৯৫১-র এপ্রিলে) বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য আয়োজিত শ্রী অরবিন্দ স্মারক সম্মেলনের চেয়ারম্যান হিসাবে ঘোষণা করেন। যে বিশ্ববিদ্যালয় ঋষি অরবিন্দর দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে তৈরি হবে এবং দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন একটি দিশা প্রদান করবে।
শ্যামাপ্রসাদ তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রমাণ রেখেছিলেন বাংলার অর্থমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করে। মুসলিম প্রধান ‘কৃষক প্রজা পার্টি’র সঙ্গে জোট তৈরি করে তৎকালীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটা ভারসাম্য বজায় রাখার কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। মুসলিম লিগ-এর সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর সক্রিয় প্রচেষ্টাকে এবং ঔপনিবেশিক সরকারকে কাজে লাগিয়ে তারা যে ধ্বংসাত্বক রাজনীতি ও ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করেছিল তা দক্ষতার সঙ্গে তিনি প্রতিহত করেছিলেন নিজের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে।
আরও পড়ুন: ১৯৪৬ সালে শ্যামাপ্রসাদের করা মন্তব্য কি আজও প্রাসঙ্গিক?
দেশের বিকাশের জন্য তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়েছিল ১৯৪৭-৫০ সালে, যখন তিনি দেশের প্রথম শিল্প ও সরবরাহ মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই সময়কালে তিনি ভারতের শিল্পর ভিত গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম যে শিল্পনীতি তৈরি হয়েছিল তাতে তাঁর পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতার ছাপ স্পষ্ট। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল- ভারত যাতে শিল্প এবং পরিকাঠামোগত দিক দিয়ে স্বনির্ভর হতে পারে তা সুনিশ্চিত করা। শ্যামাপ্রসাদ চেয়েছিলেন দেশে ভারী শিল্প’র পাশাপাশি ক্ষুদ্র, মাঝারি, কুটির, হস্ত এবং বস্ত্র শিল্পে ভারত প্রভূত উন্নতি করুক। তাঁর শিল্প মন্ত্রিত্বের সময়কালেই দেশে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ভিত স্থাপিত হয়েছিল।
ভারতকে স্বনির্ভর শক্তিশালী এক রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং সকলের মধ্যে শিক্ষা-জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ তাঁকে অনুপ্রাণিত করত এবং এই কাজে তিনি আত্মবিশ্বাসী এবং দৃঢপ্রতিজ্ঞ ছিলেন।