বিখ্যাত মানুষদের নিয়ে তাঁদের ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা বই লিখেছেন, এরকম উদাহরণ অনেক আছে। এমন একটা বই লিখেছিলেন মাও সে তুং-এর চিকিৎসকও। কলকাতার বই বাজারে প্রায় ‘হটকেক’ ছিল। প্রায় হাজার পাতার বই। বয়স তখন অনেক কম। পড়ে ফেলেছিলাম। শেষ পাতায় পৌঁছানোর পর মনে হয়েছিল এটা পর্ণোগ্রাফি।
সম্প্রতি আর একজন বিখ্যাত মানুষের ব্যক্তিগত চিকিৎসকের লেখা বই পেলাম। এক বন্ধু পাঠিয়েছেন- ‘দি আনসিন ইন্দিরা গান্ধী’। লিখেছেন তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. মাথুর। ডা. কে পি মাথুর। বাজারে ম্যাডাম সম্পর্কে বই-এর অভাব নেই। এটা আবার নতুন কি- এই মনোভাব নিয়ে দুপুরে খাবার পর পাতা খুললাম। সন্ধ্যার মধ্যে শেষ করে উঠতে হল। মাঝারি সাইজের বই, ছোট নয়। কিছুটা সুন্দর ও সহজ ইংরাজি’র গুণ। সঙ্গে গল্প বলার নিটোল ঢঙ।
প্রধানমন্ত্রীর আবাসে ইন্দিরা গান্ধী নিজেই ঠিক করতেন সকালে সারা দিন কি কি রান্না হবে। সোনিয়া গান্ধী সংসারে আসার পর সেটা তাঁর হাতেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। ঘরে কি হবে, সে বিষয়ে ‘বহুরানী’ সোনিয়াকে জিজ্ঞাসা করার জন্য কাজের লোকদের বলতেন ইন্দিরা। এই সব ব্যাপারে মানেকাকে তিনি জড়াতেন না।
বাড়ির সকলের সঙ্গে দেওয়ালী পালন করতে চাইতেন। একবার রাজীব ও সঞ্জয় দুন স্কুলে। স্কুলে ছুটি নেই। তারা আসতে পারবে না। সবাইকে নিয়ে তিনি চললেন সেখানে। কিন্তু স্কুলের কড়া নিয়ম। সন্ধ্যের আগে হস্টেলে ফিরতে হবে। সেই কারণে দিনের বেলাতে বাজি পোড়ানো এবং খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হল। সন্ধ্যার আগেই তাদের হোস্টেলের সুপারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হল।
ডাক্তার মাথুর বলেছেন, ফিরোজ গান্ধীর সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর সম্পর্কের টানাপোড়েন ছিল। ফিরোজ কোনও দিন প্রধানমন্ত্রীর আবাসে থাকতে আসেননি। তবে ফিরোজ যখন রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতালে ভর্তি তখন প্রতি বিকেলে ইন্দিরা সেখানে গিয়ে তাঁকে সঙ্গ দিয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর পরেও ফিরোজের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেননি। একবার তাঁদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে গিয়ে মুম্বইতে সবার সঙ্গে কাটিয়েছিলেন।
তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ যুদ্ধের পর জুলফিকার আলী ভুট্টো এলেন ভারতে। সিমলাতে বৈঠক হবে। ভারতেরও তাগিদ ছিল। হাজার হাজার পকিস্তানী বন্দীকে তো ফেরত পাঠাতে হবে! ভুট্টোর জন্য ব্যবস্থাপনা ইন্দিরা নিজের হাতে করেছিলেন। সমস্যা হল, প্রতিনিধি দলে যাঁরা ছিলেন তাঁরা সবাই নিরামিষ খাবার অর্ডার দিচ্ছেন। এত ব্যবস্থাপনা, সব জলে যাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলে পাক-প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বলছেন- বাড়িতে রোজই আমিষ খাই, এখানে না হয় নিরামিষ খেলাম! কথাটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ভারতের উৎকৃষ্ট বিরিয়ানি কেউ খাবে না হতেই পারে না। সামলে দিলেন মহম্মদ ইউনুস। ইন্দিরার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সবাইকে ডেকে বললেন- ওরে বোকার দল- হালাল না ঝটকা বুঝতে পারছে না, তাই খাচ্ছে না। হালাল বলে দাও। দেখো কি হয়! তাই করা হল। আর যায় কোথায়। ইন্দিরা নাকি এরজন্য ইউনুসকে একটা পুরস্কার দিয়েছিলেন। তবে সেটা কি, তা অবশ্য ডা. মাথুর জানেন না। একটা কারণে বইটা অসম্পূর্ণ বলে আমার মনে হয়েছে- সিমলা কান্ডে বেনজির ভুাট্টোর কোনও উল্লেখ নেই।
পিসি বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত-এর সঙ্গে ইন্দিরার সম্পর্ক বরাবর খারাপ। ইন্দিরাকে তিনি ‘অশিক্ষিত’ বলে মনে করতেন। ইন্দিরাও ততোধিক অপছন্দ করতেন তাঁকে। রাষ্ট্রসঙ্ঘে বিজয়লক্ষ্মীকে স্থায়ী প্রতিনিধি করে ইন্দিরা তাঁকে দূরে সরিয়ে দেন। ডা. মাথুরের উপর তিনি খুব চোটপাট করতেন। একেবারেই ঘরোয়া কোন্দল। তা না হলে, ড. অশোক মিত্র যখন বিজয়লক্ষ্মীর বাল্য প্রেম নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন, তা দেখে ইন্দিরা বলেছিলেন- ‘অশোক লেখার আগে একবার আমার সঙ্গে কথা বললো না! তাহলে আমি তাকে আরও তথ্য দিতে পারতাম- যা আরও চমকপ্রদ।’ ঝগড়াতে কি না বলে!
ইন্দিরা যে অসম্ভব স্মার্ট এবং ‘ম্যানেজার’ ভদ্রমহিলা ছিলেন সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। দক্ষিণের উঠতি নেত্রী জয়ললিতাকে নিজের চেয়ার ছেড়ে বসতে দিয়েছেন। কানে নেওয়া যায় না, এমন ভাষায় বৃদ্ধ কংগ্রেস নেতাদের গালাগালি দিয়েছেন। কাউকে পাত্তা দেননি। রাতে এক সিদ্ধান্ত করেছেন সকালেই তা পাল্টে দিয়েছেন। কিন্তু সঞ্জয়ের মৃত্যু’র পর মা’এর আসল রূপ বেরিয়ে পড়েছে। ‘আমার ডান হাত কাটা গেল’ বলে মন্তব্য করছেন। এ’কথা সবার জানা যে রাজীব গান্ধী রাজনীতি সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু ইন্দিরা তাঁকে জোর করেই এ’ব্যাপারে যুক্ত করেন। তারপরের ইতিহাস সকলের জানা। সোনিয়া-রাজীব-ইন্দিরা একটি অদ্ভূত ত্রিকোন তৈরি করেছেন ডা. মাথুর। যা গড়পড়তা বইতে পাওয়া যায় না।
মৃত্যুর আগে কার সঙ্গে শেষ কথা বলেছেন ইন্দিরা গান্ধী। এটা এক সময় বড়চর্চার বিষয় ছিল। ডা. মাথুরের সঙ্গে বলেছেন। ডাক্তার প্রাত্যহিক চেকআপ শেষ করেছেন। তার আগেই ইন্দিরা তার সকালের খাবার খেয়ে তৈরি। তাড়াতাড়ি করছিলেন। কারণ, একটা ইন্টারভিউ দেবেন। লন দিয়ে পাশের বাড়ি যাবেন। ডাক্তার প্রেশার মাপলেন, হার্টবিট দেখলেন, চোখ টানলেন। সব একেবারে কাঁটায় কাঁটায় ঠিক। একসঙ্গে দু’জনে বেরোলেন। ডাক্তার তাঁর গাড়িতে উঠলেন। তার আগে দু’জনই দু’জনকে বললেন ‘হ্যাভ এ নাইস ডে’। ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন এইমস-এর দিকে। আর ইন্দিরা গান্ধী এক ঝাঁক-গুলির সামনে।